‘ছেলেপুলে যদি ফেলে দেয়, কোথায় যামু’

৫০ লাখের মতো প্রবীণ মাসিক ৬০০ টাকা সরকারি ভাতা পান

আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস আজ

ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর সড়কে বসে ৭৫ বছর বয়সী হালিমা বেগম (আসল নাম নয়) অঝোরে কাঁদছিলেন। কাছে যেতেই জানালেন, বড় ছেলে তাঁর জমি বেচে দিয়েছে। একদিন বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেছে। এখন তিনি পথেই থাকেন। ক্ষুধা লাগলে ভিক্ষা করেন। হতাশ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আমি তো ছেলেপুলের জন্যই বাঁচছিলাম। এখন তারাই যদি ফেলে দেয়, আমি কোথায় যামু মা।’

বাকপ্রতিবন্ধী ৬৫ বছর বয়সী আনোয়ারা বেগমের জীবনের গল্প আরও বেদনার। ছেলে কুদ্দুস সিকদারের আয় লাখ টাকা হলেও মা পথে পথে ভিক্ষা করে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। আনোয়ারা এখন কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকার হাবিবের বস্তিতে থাকেন।

৭২ বছর পেরোনো আবদুল মালেকের কাহিনিও করুণ। একতলা বাড়ি নিয়ে ছেলেমেয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলে একদিন তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। এখন তিনি গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। মালেক বলেন, ‘ঘরবাড়ি, জমি-জিরাত সব ছেলেমেয়ের নামে লিখে দিয়েছিলাম। এখন তারা আমার খবর নেয় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি বোঝা হয়ে গেছি।’

হালিমা, আনোয়ারা ও মালেকের মতো অসংখ্য প্রবীণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন সন্তানের অবহেলা, নির্যাতন কিংবা সম্পত্তি দখলের শিকার হয়ে। আবার কেউ কেউ থাকছেন প্রবীণ নিবাসে। এমন বাস্তবতায় আজ নানা কর্মসূচিতে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য– ‘একদিন তুমি পৃথিবী গড়েছ, আজ আমি স্বপ্ন গড়বো, যত্নে তোমায় রাখবো আগলে’।

সংখ্যায় প্রবীণ, সেবায় শূন্যতা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ। জাতিসংঘ বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা হবে ৩ কোটিরও বেশি। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার বড় অংশই হবে প্রবীণ। তবে তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পারিবারিক নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত হচ্ছে– এটিই বড় প্রশ্ন। সরকারি বয়স্ক ভাতা কর্মসূচির আওতায় বর্তমানে ৫০ লাখের মতো প্রবীণ মাসিক ৬০০ টাকা ভাতা পান। তবে দেশের মোট প্রবীণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় এটি অপ্রতুল। 

পরিবারের ভরসা ভেঙে পড়ছে
বাংলাদেশে প্রবীণের প্রধান ভরসা ছিল পরিবার। তবে দ্রুত নগরায়ণ, যৌথ পরিবার ভেঙে ছোট পরিবারে রূপান্তর এবং প্রবাসে যাওয়ার প্রবণতার কারণে মা-বাবার প্রতি যত্ন নেওয়ার সংস্কৃতি কমে আসছে। জাতীয় প্রবীণ ফোরামের এক জরিপে উঠে এসেছে, প্রবীণের ২৭ শতাংশই তাদের সন্তান বা নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে অবহেলিত। প্রায় ১৮ শতাংশ প্রবীণ জানান, সন্তানরা সরাসরি তাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছেন। কেউ কেউ বৃদ্ধ মা-বাবাকে সরাসরি বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কেউ ফেলে যাচ্ছেন রাস্তায়।

স্বাস্থ্যসেবাও জোটে না
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণের সবচেয়ে বড় চাহিদা হয়ে ওঠে স্বাস্থ্যসেবা। তবে সরকারি হাসপাতালে প্রবীণবান্ধব সেবা এখনও কার্যকরভাবে গড়ে ওঠেনি। চিকিৎসকরা জানান, প্রবীণ বেশির ভাগই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চোখ ও হাড়ের সমস্যায় ভোগেন। তাদের জন্য বিশেষ সেবা খুবই সীমিত। স্বাস্থ্যসেবার খরচও সামর্থ্যের বাইরে। প্রবীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ৬২ শতাংশই কোনো না কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন। তাদের মধ্যে নিয়মিত চিকিৎসা পান মাত্র ৩৫ শতাংশ।

আইনের সুরক্ষা, বাস্তবে দুর্বলতা
২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা প্রণয়ন করে। সেখানে প্রবীণদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, আবাসন, আইনি সহায়তা, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে নীতিমালা বাস্তবায়ন খুব সীমিত পর্যায়ে আটকে আছে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, ‘মা-বাবার ভরণপোষণ আইন থাকলেও আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে সন্তানের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করতে চান না। ফলে এ আইনে তেমন মামলা হয় না।’ 

আইনজীবী ওয়ালিউর রহমান দোলন বলেন, ‘আইন অনুযায়ী সন্তানরা মা-বাবার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। বাস্তবে এমন অনেক মামলা আমরা পাই, যেখানে প্রবীণ মা-বাবা মামলা করলেও সামাজিক চাপ আর দীর্ঘসূত্রতার কারণে ন্যায়বিচার পান না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *